উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এর ভূমিকা কি ছিল

নাহিদ ইসলাম একজন বাংলাদেশী ছাত্র কর্মী যিনি 2024 সালের বাংলাদেশ অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।

Nov 4, 2024 - 18:15
Nov 4, 2024 - 18:17
 0  7
উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এর ভূমিকা কি ছিল
নাহিদ ইসলাম। তথ্য ও সম্প্রচার এবং ডাক ও টেলিযোগ উপদেষ্টা;

 

ভাবিনি কখনো সামনের সারিতে এসে রাজনীতি করব। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরু থেকে রাজনীতিতে আগ্রহ ছিল। যুক্ত ছিলাম প্রথম কোটা আন্দোলনে। সামাজিক একটা পরিবর্তন চাইতাম। যখন প্রথম বর্ষে পড়ি, ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনে আমার এক সহপাঠীকে আটক করা হয়। ঘটনাটি আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

২০১৯ সালে নুরুল হকের প্যানেল থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিই। কিন্তু প্রথাগত ধারার রাজনীতি কখনো সেভাবে আমাকে আকর্ষণ করেনি। তাই নুরুল হকের সংগঠনে পরে আর যুক্ত হইনি। তবে ক্যাম্পাসের যেকোনো ন্যায্য আন্দোলনে সব সময় সোচ্চার ছিলাম। ২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে যে আন্দোলন হয়, সেখানে ছিলাম। সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমার ভূমিকা ছিল। ২০২০ সালে সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী ৫৫ দিন কর্মসূচি পালন করেন। সেখানে আমরা আড্ডা দিয়েছি, মাহফুজ ভাইয়ের (মাহফুজ আলম) সম্পাদনায় কাঁটাতার নামে পত্রিকা বের করেছি। ওই সময় আমার ভেতরে একটা পরিবর্তন আসে। বুঝতে পারি, নতুনভাবে শুরু করতে হবে। তবে কী করব, তা জানতাম না। এ সময় পৃথিবীতে করোনা শুরু হল |

করোনার পর ক্যাম্পাসে ফিরে দেখলাম, আবরার হত্যাসহ আরও কিছু নিপীড়নমূলক ঘটনায় ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি যেভাবে নাজুক হয়েছিল, তারা সেটা কাটিয়ে উঠেছে—ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি দিচ্ছে, লাইব্রেরি করছে ইত্যাদি। অনুভব করলাম, ছাত্র আন্দোলন হারিয়ে যাচ্ছে। তাই একটু পড়াশোনার মধ্যে ঢুকলাম। এই পর্যায়ে মাহফুজ ভাইয়ের নেতৃত্বে অনেকটা গোপনেই শুরু হলো গুরুবার আড্ডা। রাজনৈতিক সংস্কৃতি, ছাত্র আন্দোলন, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা আর তর্ক—এভাবেই আড্ডাটা চলছিল। 

২০২২ সালে আবরারের স্মরণসভায় হামলা হয়। এ ঘটনায় সে সময় ছাত্রদের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। একপর্যায়ে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি নামে নতুন সংগঠন করলাম। এর মধ্যে ২০২৪ সালের ৬ জানুয়ারি কোনো বাধা ছাড়াই ভোটারবিহীন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এল। সবার মধ্যেই হতাশা। 

আমি তখন টিউশনি করতাম, কোচিংয়ে ক্লাস নিতাম। তবে মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ছাত্রশক্তির সাংগঠনিক বিস্তার ঘটানো। আমরা হাল ছাড়িনি। নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সংগঠনের ব্যানারে না করে সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ইফতার মাহফিল, ফিলিস্তিনের সঙ্গে সংহতি, নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে কর্মসূচি—এসব করেছি। আমাদের চিন্তা যত না ছিল সংগঠন করা, তার চেয়ে বেশি ছিল সংগঠনের হাত ধরে একটা রাজনৈতিক পরিসর রচনা এবং ছাত্রদের সেখানে যুক্ত করা। এ জন্য আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর জোর দিই। মাহফুজ ভাই, আসাদ ভাই (ভূঁইয়া মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান) মিলে পূর্বপক্ষ  রণপা নামে পত্রিকা বের করেন। পাশাপাশি চলে গুরুবার আড্ডা, রসিক আড্ডা নামের পাঠচক্র এবং ছয়চক্র নামের একটি একাডেমিক আড্ডা। আরও ছিল রাষ্ট্রকল্প লাইব্রেরি। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে এগুলো আদতে ছিল লড়াই।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সূচনা

 

৫ জুন মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিল করে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট।

এই বাস্তবতায় আমরা ওই দিন সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হই। সবাই মিলে গ্রন্থাগারের ভেতরে গিয়ে বিসিএসপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ডাকলাম। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই-ই এল। আমরা একটা দলের মতো হলাম। গ্রন্থাগারের সামনে মিছিল করে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিলাম। তখন কিন্তু আমাদের কোনো ব্যানার ছিল না। ব্যানারবিহীনভাবে মাত্র তিনটি কর্মসূচির পর কোরবানি ঈদের বন্ধ শুরু হলো। আন্দোলনে ঈদের আগে অল্প কয়েকজন মেয়ে ছিল, পরে অনেকে যোগ দেয়। আমরা আলটিমেটাম দিলাম। 

ঈদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে গোছালাম। সারা দেশে তৈরি করলাম প্রতিনিধি নেটওয়ার্ক। সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সময়ে অভিন্ন কর্মসূচি দেওয়া হলো। জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুরের বেগম রোকেয়া—বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হলো আন্দোলন। ঈদের ছুটিতে আমরা বিভিন্ন সার্কেলে গিয়েছি, বুদ্ধিজীবীদের কাছে গিয়েছি। তেমন সাড়া পাইনি। 

ঈদের পর ১ জুলাই আন্দোলন শুরু হলেও ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে যাত্রা শুরু হয় ৫ তারিখ। ‘কোটা পুনর্বহাল চাই না’ ফেসবুক গ্রুপে নাম আহ্বান করলে এই নামের পক্ষে বেশি ভোট পড়ে। আর এমন নাম দেওয়ার কারণ হলো, কোটা নিয়ে ২০১৮ সালের আন্দোলনটা ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থের জায়গা থেকে। ফলে এমন একটা নাম আমরা দিতে চেয়েছি, যাতে নামের মধ্যেই একটা নীতি প্রতিফলিত হয়। শুধু চাকরি নয়, এ আন্দোলনের মাধ্যমে দুর্নীতির বিতাড়ন, ভালো আমলাতন্ত্র—এসবও যুক্ত করতে চেয়েছিলাম। করা যায়নি। মাঠে শুধু বৈষম্যবিরোধীটাই টিকে গেছে। 

আন্দোলনে সব সময় ভিন্ন ধরনের নামে কর্মসূচি দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমরা। হরতাল-অবরোধ—এসব খুব প্রচলিত। মানুষ জানে এখানে কী হয়—একটা বাধা আসে, পুলিশ বা ছাত্রলীগ হামলা করে। তাই আমরা ‘বাংলা ব্লকেড’ নাম দিলাম এই চিন্তা করে যে শহুরে মধ্যবিত্ত এখানে যুক্ত হোক। আবার জেন-জি প্রজন্মও যেন যুক্ত হয়, তা-ও আমাদের লক্ষ্য ছিল। এই ভিন্নধর্মী কর্মসূচির প্রভাব কিন্তু আন্দোলনে বেশ ভালোভাবেই পড়েছে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করার মধ্য দিয়ে আন্দোলন যখন দমনের চেষ্টা হলো, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন। আবার দোয়া-মোনাজাত, গায়েবানা জানাজা—এ ধরনের কর্মসূচিও ছিল আমাদের। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এতে সংযুক্ত হয়েছেন। আদতে আমরা ডান-বাম, শহর-গ্রামসহ নানান মতাদর্শের মানুষ যেন একটা জায়গায় দাঁড়াতে পারে—এমন এক পরিসর তৈরি করতে চেয়েছি।

আমাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল মধ্যপন্থী। বামপন্থী-ইসলামি-বিএনপিপন্থী—সবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। এ অবস্থানের কারণে সবার সঙ্গেই আমরা মিশতে পারতাম, এখনো পারি।

আন্দোলনের আরেকটি কৌশলগত দিক ছিল একক নেতৃত্ব না রাখা এবং পরিচিত কাউকে সামনে না আনা। আমি যেহেতু পরিচিত ছিলাম না, তাই সামনে ছিলাম। এমনকি প্রথম দিকে জুনিয়ররা সামনে ছিল। প্রতিদিনই গান-কবিতা হচ্ছে। অপরিচিতদের দেখে সবাই যুক্ত হচ্ছে। কেউ বুঝতেই পারেনি, এখানে নেতৃত্বটা দিচ্ছে কে।

শেখ হাসিনা তখন দেশে ছিলেন না, চীনে গিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছি, দেশে ফিরে তিনি ইতিবাচক কিছু একটা বলবেন। কিন্তু ১৪ জুলাই তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটূক্তি করলেন। কথাটি সবার আত্মমর্যাদায় আঘাত করল। ওই রাতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হল থেকে বেরিয়ে এলেন ক্যাম্পাসের সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা।

৫ জুলাই মেয়েদের ওপর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা হামলা করল। ক্যাম্পাস থেকে আমরা বিতাড়িত হলাম। ১৫ তারিখ রাত থেকে একটু একটু পালিয়ে থাকতে শুরু করি। মুঠোফোন বন্ধ রাখি। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদসহ ছয়জন শহীদ হন। এদিন বিকেলে শহীদ মিনারে আমাদের কর্মসূচি ছিল। সবাই লাঠি নিয়ে শহীদ মিনারে এলেন। আমি ঘোষণা করলাম, আবু সাঈদ শহীদ হয়েছেন। মারা যাওয়ার আগের দিনও বাকেরের (আবু বাকের মজুমদার) সঙ্গে তাঁর কথা হয়।

আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর থেকেই মূলত আন্দোলন সর্বব্যাপকতা লাভ করে। গণজোয়ার শুরু হয়। জাহাঙ্গীরনগর, ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিরোধ করে তাদের বিতাড়িত করেন শিক্ষার্থীরা। মেয়েদের হলে শুরু হয় প্রতিরোধ। এ আন্দোলনে মেয়েদের ভূমিকা ছিল ব্যাপক। আন্দোলনের বড় শক্তিও তাঁরা।