স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রবাসী যারা ভূমিকা রেখেছেন
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে প্রবাসী যারা ভূমিকা রেখেছেন Expatriates who played a role in the anti-dictatorship movement চলতি বছরের গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে।
চলতি বছরের গত ৫ই আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এর পেছনে দেশের ছাত্র-জনতা যেমন ভূমিকা রেখেছিল, তেমনি একঝাঁক প্রবাসী বাংলাদেশি সাংবাদিক ও কন্টেন্ট ক্রিয়েটররাও অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসন, খুন, গুম ও লুটপাটের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন তারাও। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা ও অষ্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অনলাইন ও গণমাধ্যমে টকশোতে অংশ নিয়ে সরকারের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখেন তারা। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থেকেছেন এসব প্রবাসী।
এদের মধ্যে লন্ডনের সাংবাদিক রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী সুয়েব, যুক্তরাষ্ট্রের এম রহমান মাসুম, আলাউর খন্দকার, কানাডার ড. তাজ হাশমী, ফ্রান্সের সাইফুর সাগর ও অস্ট্রেলিয়ার মুন্নী চৌধুরী মেধাসহ আরো অনেকেই রয়েছেন। যারা ছিলেন নিয়মিত সরব।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের কারণে এসব সাংবাদিকদের অনেকেই এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দেশে আসতে পারেননি। তবে স্বৈরাচার সরকারের হুমকি-ধমকি, রোষানল তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। তারা প্রতিবাদ চালিয়ে গিয়েছেন প্রতিনিয়ত।
এমনকি সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের পরামর্শে দেশের একটি জাতীয় দৈনিকেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালের ৬ অক্টোবর ফয়সল চৌধুরী, পিনাকী ভট্টাচার্য ও তাজ হাশমীকে নিয়ে ‘দেশবিরোধী ভয়ানক তিন সাইবার দুর্বৃত্ত’ শিরোনামে ওই জাতীয় দৈনিকে প্রধান সংবাদ প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে ফয়সল চৌধুরীকে দেশবিরোধী দিগভ্রান্ত আখ্যায়িত করে বলা হয়, তিনি বিদেশে বসে মিথ্যাচার, উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত এবং দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে দেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
এতে আরও বলা হয়, সরকার, প্রধানমন্ত্রী, শিল্পপতি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে বিষোদগার ও গুজব ছড়ানোই কথিত সাংবাদিক ফয়সল চৌধুরী সুয়েবের মূল কাজ। ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের বিরুদ্ধে তিনি মিথ্যাচার করে চলেছেন। এছাড়া অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সালমান এফ রহমান, জুনাইদ আহমেদ পলক, আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ, এস আলম গ্রুপ, এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ও পদ্মা ব্যাংকের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিস শরাফতসহ বিভিন্ন জনের বিরুদ্ধে ইচ্ছামাফিক বিষোদগার করে যাচ্ছেন এই স্বঘোষিত পণ্ডিত।
লন্ডনে বসবাস করেন রেজা আহমদ ফয়সল চৌধুরী। ঢাকার স্যাটেলাইট টিভি ‘চ্যানেল আই’র ইউরোপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তিনি।
বহির্বিশ্বে ফয়সল চৌধুরীই প্রথম টিভি চ্যানেলটির মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের অন্যায়-অত্যাচার, গুম-খুনের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেন।
তার সঞ্চালনায় চ্যানেল আই-ইউকেতে ‘স্ট্রেইট ডায়ালগ’ শিরোনামে টকশো সম্প্রচারিত হয়। ২০১৩ থেকে টানা ২০১৮ সাল পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া ‘স্ট্রেইট ডায়ালগে’র কারণে আওয়ামী লীগ সরকার তার ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। এক পর্যায়ে টকশোটি বন্ধ করতে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ হাইকমিশন নানা তৎপরতা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে হাসিনা সরকারের চাপে ঢাকার চ্যানেল আই কর্তৃপক্ষ লন্ডনে চ্যানেল আই এর সম্প্রচার এক দিনের নোটিশে বন্ধ করে দেয়। অভিযোগ করা হয়, লন্ডন স্টুডিওতে কেক কেটে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের জন্মদিন উদযাপন করা হয়েছে।
তব এসব করেও স্বৈরাচার সরকারের অপকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেমে থাকেনি। ‘চ্যানেল ইউরোপ ফেসবুক পেজ’, ‘স্ট্রেইট ডায়ালগ ইউটিউব চ্যানেল’ ও ‘আইপিটিভি চ্যানেল ইউরোপ; দিয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন তিনি।
এছাড়া গত বছরে ডিসেম্বরে সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকের কাছে বাংলাদেশ সরকারের দুঃশাসনের কিছু চিত্র তুলে ধরেন ফয়সল চৌধুরী।
‘ফিফটি ইয়ার্স অব বাংলাদেশ’ বইয়ের লেখক ডক্টর তাজ হাশমী বসবাস করেন কানাডায়। সেখানে বসে শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা করে আলোচিত হন তিনি।
এদের মধ্যে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এম রহমান মাসুমও বাংলাদেশে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের কঠোর সমালোচনা করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসে ২০১২ সাল থেকে ইউটিউব-ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইংরেজি ভাষায় আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠান শুরু করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, ইউরোপিয়ান মেম্বার অব পার্লামেন্ট, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মীদের তার অনুষ্ঠানে যুক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেন। সে সময় তার অনুষ্ঠান থেকে দেশের প্রকৃত অবস্থা জানতে পারত মানুষ।
মধ্যপ্রাচ্যের প্রবাসীদের দুর্দশা ও তাদের অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন এম রহমান মাসুম। যিনি সরজমিন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করে তাদের অবস্থা দেখেন এবং একটি প্ল্যাটফর্মে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য ‘রেমিট্যান্স ফাইটার্স অব বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠন গঠন করেন। এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এছাড়া কানাডা থেকে ‘ফেস দ্য পিপল’ নামে টকশো করে শেখ হাসিনা সরকারের কাছে বিতর্কিত হন সাইফুর সাগর, ফ্রান্স থেকে সুসময় শরীফ ও সিডনি থেকে বনী আমীন। টকশোতে অতিথি হয়ে মালয়েশিয়া থেকে ডা. ফয়জুল হক,ব্যারিস্টার সরওয়ার হোসেনসহ অনেকে হাসিনা সরকারের পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। লন্ডন থেকে আরিফ আল মাহফুজ শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে অনলাইনে জনমত গঠনেও ভূমিকা রাখেন।
এদিকে লন্ডন থেকে সাংবাদিক আব্দুর রব ভুট্টোও স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনিও সরকারের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নায়েব আলী। তিনি হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।
২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলনে ভুল তথ্যের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হয়ে কারাবরণ করেন নূরে আলম হামিদী। তিনি বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী। পাকিস্তানি নাগরিক ও লস্কর-ই-তৈইয়্যবার স্কোয়াড লিডার হিসেবে পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন এমনকি জাতীয় সংসদে নূরে আলম হামিদীকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিল।
আমেরিকায় বসবাস করেন আলাউর খন্দকার। আমেরিকা বাংলা চ্যানেল (এবিসি) নামে একটি টিভিতে টকশো করে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা বিরোধী আন্দোলনে জোরালো ভূমিকা রাখেন তিনি।
ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মোখলেসুর রহমান চৌধুরী দীর্ঘদিন থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন। তিনি পতিত হাসিনা সরকারের নানা অপকর্ম, দুঃশাসন ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সে সময় সরব ছিলেন। লন্ডন-আমেরিকার বেশ কয়েটি চ্যানেলের টকশোতে নিয়মিত অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে জোরালো ভূমিকাও পালন করেন মোখলেসুর রহমান।