‘সালাউদ্দিন বেস্ট, তাকে সভাপতি হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের বিষয়’
বাফুফের নারী উইংয়ের চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ রোববার দুপুরের দিকে বাফুফে ভবনে আসেন। স্বাভাবিকভাবেই ২৬ অক্টোবর নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে কিরণের সঙ্গে কথা বলতে অপেক্ষায় ছিলেন গণমাধ্যমকর্মীরা।
বিশেষ করে মেয়েদের চ্যাম্পিয়ন হওয়া, আগামীতে মেয়েদের নিয়ে কি পরিকল্পনা, ঘরোয়া ফুটবল আরো শক্তিশালী করা, মেয়েদের বেতন ও আবাসন সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন কিরণ।
বাংলাদেশ ব্যাক টু ব্যাক চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মেয়েরাও বলেছে সারাবছর ট্রেনিংয়ের মধ্যে থাকার কারণে তাদের এই সাফল্য এসেছে। এরপর অনুশীলনে কোনো ঘাটতি ছিল কিনা সে বিষয়ে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছেন, ‘সারাবছর মেয়েদের ট্রেনিংয়ের মধ্যে রাখি। তারপরও অনুশীলন ম্যাচের গুরুত্ব আলাদা। প্র্যাকটিস ম্যাচের মাধ্যমে ফিটনেস লেভেল আপ হয়। ম্যাচ খেললে মেয়েরা বুঝতে পারে, কোচ বুঝতে পারেন- সবাই কোন পর্যায়ে আছে। এই জায়গাটায় আমাদের একটা ঘাটতি ছিল। নানা পরিস্থিতির কারণেই আমরা পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলতে পারিনি। এটা ইচ্ছাকৃত ছিল না।’
নারী ফুটবলে বাফুফের সাবেক সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিনের আলাদা নজর ছিলো। মাহফুজা আক্তার কিরণ সাবেক সভাপতির অবদানের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘ফুটবলের এই সাফল্যের জন্য আমি আবারো ধন্যবাদ দেবো কাজী মো. সালাউদ্দিনকে। তার মতো সভাপতি যদি বাফুফেতে না থাকতেন, তাহলে মেয়েদের এই সাফল্য আমরা কোনোদিনও দেখতাম না। আশা করবো বর্তমান সভাপতি তাবিথ আউয়াল তিনিও ফুটবলের ব্যাপারে পজিটিভ, মেয়েদের ফুটবল নিয়ে আরো পজিটিভ। তিনিও পাশে থাকবেন এবং আমরা একইভাবে মেয়েদের ফুটবল নিয়ে এগিয়ে যাবো।’
মেয়েদের ফুটবলের উন্নয়নে কাজ করতে কখনো পিছপা হননি উল্লেখ করে কিরণ বলেছেন, ‘আমি বড় একটা অসুখে (ক্যান্সার) ভুগছি। সেই অসুখ নিয়ে, কেমো দিয়ে যখন দাঁড়ানো সম্ভব না, তখন জাপান চলে গিয়েছিলাম মেয়েদের ফান্ড আনার জন্য। সেই ফান্ড এনেছিলাম, এখনো চালু আছে। আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিল না। কাজী সালাউদ্দিন তো ফুটবল ছাড়া কিছু করেন না। তিনি বাঁচেন ফুটবল নিয়ে, মরেনও ফুটবল নিয়ে। বাংলাদেশে অনেক ফুটবল বোদ্ধা আছে। আমি বলবো কাজী সালাউদ্দিন দ্য বেস্ট। নিজেদের মেধা সে ফুটবলে দিয়ে গেছেন।
আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা তাকে সভাপতি হিসেবে পেয়েছিলাম। আগের সরকারের সময়ও বলেছিলাম সাপোর্ট লাগবে। আর্থিক, অবকাঠামোগত সাপোর্ট আমাদের লাগবে। সেটা না হলে ফুটবলকে আমরা নেক্সট লেভেলে নিতে পারবো না। একইভাবে এই সরকারের কাছে আমাদের সেই কথাই বলা লাগবে। আমি সরকার প্রধানকে ধন্যবাদ দিতে চাই। সরকার প্রধান মেয়েদের ডেকেছেন, সংবর্ধনা দিয়েছেন। তাদের আর্থিকভাবেই সাপোর্ট করেছেন। আগামী দিনেও তারা মেয়েদের ফুটবলের পাশে থাকলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।’
ভারত ও ইউরোপের ক্লাব থেকে কয়েকজন মেয়ের কাছে প্রস্তাব আছে। বিষয়টি আপনার কাছ পর্যন্ত এসেছে কিনা এবং প্রস্তাব পেলে আপনারা তাদের খেলার ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন কিনা- জানতে চাইলে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেছেন, ‘এ বিষয়টি আমার কাছে আসেনি। তবে যদি কোনো দেশ থেকে মেয়েদের আমন্ত্রণ আসে আমরা অবশ্যই দেওয়ার চেষ্টা করবো। আগেও যখন যার আমন্ত্রণ এসেছে আমরা চেষ্টা করেছি। আমরা মেয়েদের কখনো বঞ্চিত করিনি। আমরা চাই তারা ভালো ক্লাবে খেলতে যাক। এটাতো দেশের ফুটবলেরও সম্মান।’
সাফে তো দুইবার চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ। এখন দক্ষিণ এশিয়ার গন্ডি পার হয়ে এশিয়া পর্যায়ে যেতে হলে কি করতে হবে? মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘বছরে আমাদের ৫ থেকে ৬টি ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলতে হবে শক্তিশালী দেশের বিপক্ষে। সেটা খেলতে না পারলে এশিয়ান লেভেলে কখনো যাওয়া সম্ভব নয়। এশিয়ান লেভেলে যেতে না পারলে মেয়েরাও ইউরোপিয়ান বলেন বা অন্য কোনো ভালো লিগে খেলার সুযোগ পাবে না।’
লিগে অংশ নিতে ক্লাবগুলোকে বাধ্য করা প্রসঙ্গে কিরণ বলেন, ‘আমরা প্রত্যেক বছর লিগ শুরুর আগে ক্লাবগুলোকে চিঠি দেই এবং পার্সোনালি বলি। তারা খেলে না। কথা হলো, আমরা ক্লাবগুলো বাধ্য করতে পারি না। সেই অধিকারও আমাদের নেই। আমরা সব সময় যেভাবে বলে আসছি, এবার দরকার হলে ক্লাবগুলোকে আরো বেশি অনুরোধ করবো। আমি সব সময়ই চাই মেয়েরা লিগ খেলুক, তারা অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হোক।’
‘২০১২ সালে এই মেয়েদের যখন ক্যাম্পে তুলেছিলাম তখন ওরা ছিল অনূর্ধ্ব-১২। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে একটা ফান্ড তৈরি করে সারা দেশে ট্যালেন্ট হান্ট করে তিন মাস ট্রেনিং দিয়ে আমি মেয়েদের এখানে নিয়ে এসেছিলাম। তখন প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ফান্ড ছাড়া আর কোনো টাকা ছিল না। পরের দিন ওরা কিভাবে ভাত খাবে তাও অনিশ্চিত ছিল।
২০১২ থেকে ২০১৭ - মেয়েদের সব ব্যয় সাবেক সভাপতি কাজী মো. সালাউদ্দিন ও আমি বহন করেছি ব্যক্তিগতভাবে। ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা ছিল বলে আমরা এই কাজগুলো করতে পেরেছি। ২০১৮ সালে ঢাকা ব্যাংক আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়। তার আগে আমাদের কোনো স্পন্সর ছিল না। এখনতো মেয়েদের সবাই আদর করে সাফল্য এনে দিয়েছে তাই। আগে তো নারী ফুটবলের নামও শুনতে পারতো না কেউ।’
সামনে ফিফা উইন্ডো আছে। তখন ম্যাচ খেলার বিষয়ে কোনো অগ্রগতি আছে কিনা? ‘আমি এএফসির একটা কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিলাম। গতকাল মধ্যরাতে ঢাকায় ফিরেছি এবং আজ বাফুফেতে এসেছি। এখন পর্যন্ত এ নিয়ে কারো সাথে আমার কথা হয়নি। সবার সাথে কথা বলে আমি জানাতে পারবো’- বলেছেন কিরণ।
বাংলাদেশ তো প্রথম চ্যাম্পিয়ন হয়নি। আগেরবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর মেয়েদের অনেক দাবিদাওয়া ছিল। সেগুলো পূরণ হয়েছে কিনা এবং এবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে আরো ওপরে যাওয়ার জন্য কাজ করা হবে কিনা জানতে চাইলে মাহফুজা আক্তার কিরণ বলেন, ‘আমি সব সময় একটা কথা বলে আসছি যে, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের একার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব না। আমাদের অবকাঠামোর ঘাটিতে আছে। মাঠ নেই। আমরা অনুশীলন করাতে পারি না। খেলবে কোথায়? বাংলাদেশে যে ফুটবল আছে, বাংলাদেশ যে সাউথ এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন এটাকে আমি বলবো মিরাকল। আমাদেরতো কিছুই নেই।’
কিরণ ফুটবল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে বলেন, ‘ফুটবল উন্নয়ন করতে কি লাগে আমি জানি। আমি ফিফা কাউন্সিল মেম্বার ছিলাম। বর্তমানে এএফসি মেম্বার। আমাকে গোটা বিশ্বের ফুটবল নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। সেখানে দেখেছি ফুটবল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কি করতে হয়। আমি জানি ফুটবলে উন্নয়ন করতে হলে কি লাগে। ফুটবল উন্নয়নের জন্য সরকারের সহযোগিতা লাগে। বাংলাদেশের ফুটবল চলে পৃষ্ঠপোষকদের অর্থে। কাজী মো. সালাউদ্দিন তার নাম ও খ্যাতি বিক্রি করে যতটুকু টাকা আনতে পেরেছেন সেটা দিয়ে ফুটবল চলেছে। আমিও আমার সাধ্যমতো স্পন্সর আনার চেষ্টা করেছি।’